এম রুহুল আমিন প্রধান
দিনাজপুরের মহারাজা হাইস্কুলে মাইন বিষ্ফোরণে হৃদয় বিদারক ট্রাজেডি ঘটনার স্মরণে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত ৬ জানুয়ারী উপজেলার ৭নং দাউদপুর ইউনিয়নের হাসারপাড়া গ্রামে ওই ঘটনায় নিহত শহীদ গোলজার হোসেন (সাবু) মাইন বিষ্ফোরনে নিহত হয়েছিলেন। ওই সেই যে চলে গেছে আর ফিরে আসেনি। এভাবে নবাবগঞ্জ উপজেলার ২৮ জন শহীদ হয়েছেন। আর আহত হয়েছেন ৫ জন। তাদের স্মরণে বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলজার হোসেন সাবুর সন্তান কায়সার পারভেজ (মিলন) এর আয়োজনে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল বাদ যোহর পারিবারিক ভাবে হাসারপাড়া গ্রামে অনুষ্ঠিত হয়েছে। পারভেজ কবীর মিলনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা মোঃ আসাদুজ্জামান। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসান আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম, বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম, নবাবগঞ্জ থানার এ.এস.আই বিভূতি ভূষণ ব্রতী রায়। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন, সমাজ সেবক কামরুজ্জামান, দাউদপুর কারিগরি কলেজের অধ্যক্ষ এনামুল হক, সাংবাদিক ওয়ায়েস কুরুনী, আরটিভির হাকিমপুর প্রতিনিধি আঃ আজিজ। সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন উপজেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি এম রহুল আমিন প্রধান। বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসান আলী বলেন, ঘটনার দিন বিকেল ৩টায় আকষ্মিক ভাবে জমা করা অস্ত্র, মাইন বিষ্ফোরন হয়ে বিকট শব্দ হয়। এতে শতশত অস্ত্র জমা দিতে আসা বীর মুক্তিযোদ্ধা আর একটি যুদ্ধে জীবন বিষর্জন করেছেন। জীবন বাজি রেখে ৯টি মাস অবিরাম যুদ্ধে অংশগ্রহন করে অস্ত্র জমা দিয়ে বাসায় এসে স্বাধীনতার লালিত স্বাদ বুকে নিয়ে পরিবার পরিজন সমাজ রাষ্ট্র সহ অতিবাহিত করবেন বাকি জীবন। কিন্তু বিধি বাম সে আসা ধুলিসাৎ করে দিল মাইন বিষ্ফোরন। এ ঘটনা দিনাজপুর বাসীকে বারবার কাঁদায়। বছর পরিক্রমায় ৬জানুয়ারী আসলেই দিনাজপুরের আকাশ বাতাস শোকে ভারী হয়ে যায়। তিনি আরও জানান, যেখানে মাইন বিষ্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল ৪০ থেকে ৫০ ফিট একটি গভীর গর্ত হয়েছিল। বিষ্ফোরণে নিহতদের শরীরের ছিন্ন ভিন্ন অংশ ছিটকে গিয়ে পড়ে আশপাশে এবং গাছের ডালে ও ছাদে। ওই ঘটনায় যারা মৃতুবরণ করেছিল মহান আল্লাহ তাআলা তাদের প্রকৃত শাহাদতের মর্যাদা দান করুন। আয়োজক কায়সার পারভেজ মিলন অশ্রু সজল চোখে জানান, বাবার মৃত্যুতে যেন আমি সব কিছু হারিয়েছি। এ দিনটি আসলেই আমি ও আমার পরিবারে বেদনার জায়গা বড় হয়ে যায়। বাবা হারানোর পর অনেক কষ্টে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছে। সরকারি ভাবে শহীদ পরিবারকে বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও তা থেকেও বঞ্চিত রয়েছি। সব শেষে বড় চাওয়া যেটা অনেক মুক্তি যোদ্ধা, শহীদ এর নামে রাস্তা নামকরন নবাবগঞ্জে করা হলেও সে সুবিধা থেকেও বঞ্চিত আমার শহীদ পিতা গোলজার হোসেন (সাবু)। তার পিতার স্মরণে একটি রাস্তার নাম করণের আবেদন দিনাজপুর জেলা প্রশাসক সহ উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে দেয়া হয়েছে। কবে এটা বাস্তবায়ন হবে তা জানি না। ৬ জানুয়ারি। দিনাজপুরের মহারাজা স্কুল মাইন বিস্ফোরণ ট্র্যাজেডি দিবস। ১৯৭২ সালের এই দিনে দিনাজপুরের মহারাজা স্কুলে মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্পে এক আকষ্মিক মাইন বিস্ফোরণে একসঙ্গে শহীদ হন পাঁচশতাধিক মুক্তিযোদ্ধা। আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন অনেকেই। ইতিহাসের পাতায় এই দিনটি একটি শোকাবহ দিন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাস। দীর্ঘ ৯ মাস জীবন বাজি রেখে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা লাল-সবুজের একটি পতাকা ও একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ জাতিকে উপহার দিয়ে এ সময় বাড়িতে ফিরে গিয়ে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে আনন্দ উৎসব করার কথা। কিন্তু তারা মনে করেছিল দেশ স্বাধীন হলেও দেশবাসী এখনো শঙ্কামুক্ত নন। দেশ স্বাধীন হলেও পাক সেনাদের পুঁতে রাখা মাইনের কারণে এদেশে ভূমি এখনও দেশবাসীর জন্য স্বাধীন নয়। তাইতো তারা এদেশের ভূমিকে দেশবাসীর জন্য স্বাধীনভাবে চলাফেরার উপযোগী করার জন্য নিয়োজিত হয়েছিল মাইন অপসারণের কাজে। দিনাজপুর শহরের উত্তর বালুবাড়ীর মহারাজা স্কুলে মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্প। বিজয় অর্জনের পর ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ক্যাম্পে এসে সমবেত হন দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়সহ আশপাশের জেলাগুলোর মুক্তিযোদ্ধারা। তারা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হামজাপুর, তরঙ্গপুর, পতিরাম ও বাঙ্গালবাড়ী ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এখানে সমবেত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৮ শতাধিক। রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশকে শত্রুদের পুঁতে রাখা মাইনমুক্ত করতে সমবেত মুক্তিযোদ্ধারা কাজ করছিলেন। ক্যাম্প থেকে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা বেরিয়ে পড়তেন পাক সেনাদের ফেলে যাওয়া, লুকিয়ে রাখা ও পুঁতে রাখা মাইন ও অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদের সন্ধানে। সন্ধ্যার দিকে উদ্ধারকৃত মাইন ও অস্ত্রাদি জমা করা হতো মহারাজা স্কুলের দক্ষিণাংশে খনন করা বাংকারে। ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি ঠিক মাগরিবের নামাজের পর দুটি ট্রাক থেকে মাইন নামানোর সময় হঠাৎ এক মুক্তিযোদ্ধার হাত থেকে একটি মাইন ফসকে পড়ে যায় জড়ো করা মাইনের ওপর। সঙ্গে সঙ্গেই বিস্ফোরণ ঘটে জড়ো করা হাজারো মাইনের। কেঁপে উঠে গোটা দিনাজপুর। প্রাণ হারান সেখানে অবস্থান নেয়া পাঁচ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা। আহত হয় শত শত মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের শরীরের ছিন্ন ভিন্ন অংশ ছিটকে গিয়ে পড়ে আশপাশে এবং গাছের ডালে। মুক্তিযোদ্ধাদের এসব ছিন্ন ভিন্ন অংশ জড়ো করে সমাহিত করা হয় সদর উপজেলার চেহেলগাজী মাজারে।
মন্তব্য করুন