নৈতিকতা শব্দটির ইংরেজি – Morality। যার অর্থ হলো ভদ্রতা, চরিত্র, উত্তম আচরণ। এটি মূলতঃ ভালো-মন্দ,উচিত-অনুচিত, ন্যায় – অন্যায়, ঠিক – বেঠিক, আসল – নকল এর পার্থক্যকারী।নৈতিকতার উদাহরণ হলোঃ “আমার উচিত অন্যের সাথে সেভাবেই আচরণ করা যেমনটা আমি নিজে আরেকজনের নিকট থেকে আশা করি।”নৈতিকতাকে ন্যায্যতা কিংবা সঠিকতাও বলা যেতে পারে। ন্যায় কে ন্যায় , অন্যায় কে অন্যায়, সাদা কে সাদা, কালো কে কালো বলাও নৈতিকতা। অপরদিকে, অনৈতিকতা হলো নৈতিকতারই সম্পূর্ণ বিপরীত। ন্যায় কে ন্যায়, অন্যায় কে অন্যায়, সাদা কে সাদা কিংবা কালো কে কালো বলতে না পারা। যা অসচেতনতা, অবিশ্বাস, উদাসীনতারই বহিঃপ্রকাশ ।নৈতিকতার অভাবে দেশ ও জাতির উন্নতি ব্যাহত হয়। যোগ্য ব্যাক্তিরা যোগ্য স্থানে পৌঁছাতে পারে না।অযোগ্যদের আস্ফালন বৃদ্ধি পায়। যোগ্য ব্যাক্তিরা হীনমন্যতায় ভোগে। সমাজ তথা দেশে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের সন্তানরা পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করছে। এরাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। নৈতিক শিক্ষার অভাবে পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা পাওয়ার পরেও সেবা গ্রহীতার নিকট ফকিরের মতো হাত পাতছে। অথবা ধরা যাক, জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ প্রতিযোগিতায় একজন শিক্ষক উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শ্রেণি শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। সহকর্মী কিংবা ম্যনেজিং কমিটির পক্ষ থেকে বলা হল,” শুধু শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হলে হবে না, শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী তৈরি করতে হবে! ” কেন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক কে আপনি উৎসাহিত করতে পারলেন না? এখানেই নৈতিকতার প্রশ্ন রয়ে গেল।
নৈতিক শিক্ষা হতে হবে পরিবার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পর্যন্ত। শিশুদের কে ভবিষ্যতের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের সবার। এই নৈতিক শিক্ষার মধ্যে রয়েছে সৌজন্যতাবোধ, গুণাবলীর বিকাশ, নম্রতা, শৃঙ্খলতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, সহানুভূতি, দয়া – মায়া, সাহসিকতা, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য ও আরও অন্যান্য।
একমাত্র নৈতিক শিক্ষাই শিশুদের মধ্যে দেশপ্রেমের গভীর অনুভূতি তৈরি করতে পারে। দেশের প্রতি ভালোবাসা গড়ে তুলতে গেলে শিশুদের মধ্যে ব্যক্তিগত মূল্যবোধ গড়ে তোলাও জরুরি ।
নৈতিক শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হল শিশুদের মধ্যে ধর্মীয় সহনশীলতা তৈরী করা। বাচ্চাদের বিশ্বাসের মৌলিক উপাদানের সাথে পরিচিত করানোটাও দরকার। আজকের সময়ে ধর্মীয় সহনশীলতা বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়, কারণ এখনকার অস্থির সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাদের সকলকে ধর্মের ঐক্য ও সমন্বয় সম্পর্কে জানতে হবে।
এই নৈতিক শিক্ষা পড়ুয়াদের মনে ধর্মীয় সহনশীলতা গড়ে তুলতে পারে। তাই, শিশুদের ধর্মীয় উগ্রবাদ থেকে সরিয়ে রাখতে গেলে নৈতিক শিক্ষা খুবই জরুরী।নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তোলা যেতে পারে। যাতে, অন্য জাতির প্রতি তাদের মনে কোনোরকম কোনো বিদ্বেষ বা ক্ষোভ না জন্মায়।
সমাজের অধিকাংশ মানুষ আইন অনুসরণ করে তো চলেই, বরং তারা আরও বেশ কিছু সামাজিক নিয়ম-কানুনও মেনে চলে। যে আইন ও নিয়মকানুনগুলো সাধারণত নৈতিকতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। যদিও, নৈতিকতা ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও মূল্যবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তাই সমাজে বেশ কিছু সাধারণ নৈতিকতা থাকে; যা বেশিরভাগ লোকেরাই মেনে চলে, যেমন –
সদা সত্য কথা বলা, সাহসী হওয়া, সম্পদের অপচয় বন্ধ করা, প্রতারণা না করা, আমি যেমন ব্যবহার পেতে চাই,অন্যদের সাথেও তেমন ব্যবহার করা, কাউকে অযথা বিচার না করা, অঙ্গিকার রক্ষা করা,উদার হওয়া,নম্র হওয়া,ভিন্নতার প্রতি সহনশীল হওয়া, নিজের ও অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, ক্ষমাশীল হওয়া, সৎ হওয়া ইত্যাদি।
শিক্ষা ক্ষেত্রে নৈতিক শিক্ষাকে এমনভাবে যোগ করতে হবে যাতে এই নৈতিক মূল্যবোধের বার্তা শিক্ষার্থীদের নিকট আরও সহজ, সরল ও আকর্ষণীয় উপায়ে পৌঁছাতে পারে। এর জন্যে ভালো বই, নৈতিকতা সম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, ও অন্যান্য মাa¨মও ব্যবহার করা যেতে পারে।
মানুষের জীবনে নৈতিকতা, শৃঙ্খলা, ও মর্যাদা প্রদানের জ্ঞান থাকলে তার ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সমাজ এমনকি দেশের শান্তিও বিরাজমান থাকবে।বর্তমান সমাজে ছাত্রছাত্রীদের নৈতিক শিক্ষা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা, তাদের মনে মূল্যবোধ স্থাপন করার সাথে সাথে কীভাবে অন্যের সাথে আচরণ করতে হয় তাও শেখাতে সাহায্য করে। অধিকন্তু, তাদের নৈতিক শিক্ষার মানে জানা ও বুঝতে পারাটাও ঠিক ততটাই জরুরি। শৈশবের নৈতিক শিক্ষা মানুষকে তার সমাজের মূল্যবোধ সম্পর্কে শেখায়।
মোঃ মিজানুর রহমান
প্রভাষক, গ্রন্থ প্রণেতা ও সাংবাদিক ।
মন্তব্য করুন