শিক্ষা ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের আমলে ঈর্ষণীয় সাফল্যের একটি হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ। তিন শতাধিক মাধ্যমিক বিদ্যালয় সরকারি করা হয়েছে। ৩০০ কলেজ সরকারি করা হয়েছে। ২৬ হাজার ১৯৩টি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি করা হয়েছে, এন টি আর সি এ ‘র মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দান ইত্যাদি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের ঈর্ষনীয় এই সাফল্যগুলো কিছু ব্যাক্তি নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অনেকটা ম্লান করে দিচ্ছে। এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়ার পর একজন নবীন শিক্ষক যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগদান করতে যান, তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ও ম্যানেজিং/ গভর্নিং বডির সদস্যরা বিভিন্ন অজুহাতে যোগদানে বাঁধা দেন/ কালক্ষেপণ করেন। তারা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের নামে ডোনেশন চান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগদান শেষে বেতন-ভাতার জন্য আবেদন করার সময় শিক্ষা কর্মকর্তাদের খুশি করতে হয়। অন্যথায় বিভিন্ন অজুহাতে ফাইল রিজেক্ট হতে থাকে।একই ঘটনা উচ্চতর স্কেল পরিবর্তনের সময়ও ঘটে। আবার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও ম্যানেজিং/গভর্নিং বডির সভাপতি/ সদস্যরা সাধারণ শিক্ষকের সাথে মালিক শ্রমিক আচরণ করে থাকে। এছাড়াও যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, সেই রাজনৈতিক দলের নাম ভাংগিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী লোক শিক্ষকদের পেশাগত কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। বর্তমান সমাজে একজন ব্যাক্তি যতই জ্ঞানি, সৎ ও যোগ্য হোক না কেন, তাঁর আর্থিক সামর্থ্য ভালো না হলে সমাজে তাঁর কদর নেই। এই ক্ষেত্রে শিক্ষকরা একেবারেই অনাদরণীয়। কারন তারা সারাজীবনই অর্থ কষ্টে ভোগে। একজন শিক্ষককে প্ররম্ভিক বেতন ভাতা দেওয়া হয় মাত্র ১২৫০০ টাকা। যা এই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে সংসার চালানো একেবারেই কঠিন। এরকম গরীব শিক্ষককে শিক্ষার্থী কিংবা সমাজ সম্মান করতে চায় না। সম্ভবত রাস্ট্রিয় কোষাগার থেকে বেতন ভাতা উত্তোলনকারি বৃহৎ পেশাজীবি এই বেসরকারি শিক্ষকরাই একমাত্র পেশাজীবি যারা জানেনা মাসের কত তারিখে তাদের বেতন ভাতা দেওয়া হয়। তাদেরকে বেতন ভাতার খবর পত্রিকার পাতায় দেখতে হয়! ঈদ কিংবা পুজোর সময় বেসরকারি শিক্ষকদের অবস্থা আরও নাজুক! তাদেরকে যে পরিমাণ উৎসব ভাতা দেওয়া হয় তা তাঁরা কাউকে বলতেও পারে না, সইতেও পারেনা। একজন বেসরকারি শিক্ষককে তার মূল বেতনের ২৫% এবং কর্মচারীকে ৫০% উৎসব ভাতা প্রদান করা হয়। যা এই বাজারে ঈদের/পুজোর কেনাকাটা কিংবা কুরবানি কোনটিই সম্ভব হয় না। এতো গেল চাকুরী কালিন আর্থিক দৈন্যতা। চাকুরী শেষে নিজের জমাকৃত অর্থ অবসর কিংবা কল্যাণের কোনটিই যথা সময়ে পাওয়া যায়না। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকের মৃত্যুর পর তাঁর আত্মীয় স্বজনরা এই টাকা ভোগ করে। বিনা চিকিৎসায় অনাদর, অবহেলায় মারা যান পাওনাদার শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের অনৈতিক আবদার তো আছেই। তারা বিনা পয়সায় ফরম ফিলাপ করতে চায়। ক্লাসে অনুপস্থিত থেকে পাবলিক পরীক্ষায় বসতে চায়। পরীক্ষায় নকলে বাঁধা দেওয়া তাদের পছন্দ নয়। শ্রেনি কক্ষে কিংবা ক্যাম্পাসে বখাটে বখাটে আচরণ করে। শিক্ষকরা মহা বিপদে। পরীক্ষায় নকলে বাঁধা দিলে শিক্ষার্থী কর্তৃক লাঞ্চনা, না দিলে কর্তা ব্যাক্তি কর্তৃক এমপিও স্থগিত বা চাকুরীচ্যুত করা। এ যেন জলে কুমির ডাংগায় বাঘ। একজন শিক্ষক ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মাস্টার মশাই, হাজারো পেশা থাকতে এই পেশায় কেন? রাষ্ট্র আজ উন্নতির চরম শিখরে, উন্নত রাষ্ট্রে শিক্ষার্থীদের শাসন করতে নেই, পড়া ধরতে নেই, পড়া না পারলে বকা দিতে নেই, স্কুল মাঠে সিগারেট খেলে ঐ দিকে তাকাতে নেই, ক্যাম্পাসে তারই বোনকে ধর্ষন করলে ঐ দিকে তাকানো তোমার কাজ নয়। মাস্টার মশাই তুমি কি জানোনা, উন্নত রাষ্ট্রে কিশোরদের গ্যাং আছে? তাদের মাথার উপর ছায়া আছে? তোমার স্কুলের পরিচালনা পর্ষদ এখন রাজনৈতিক বড় ভাইদের দখলে? তাদের পকেট খরচের জন্য টাকা দরকার, এলাকায় ইয়াবা সাপ্লাই এর নিরাপদ রুট দরকার, শিক্ষার্থীদের দিয়ে না করলে কাকে দিয়ে করাবে? অনেকের রাতে মেয়ে দরকার, ওরা সাপ্লাই না দিলে কে দিবে? তোমার এত্তকিছু নিয়ে মাথা ঘামানোর কি দরকার? তুমি কি দেখনি উচ্চ শিক্ষালয়ে কত্ত সুন্দর করে তরুন প্রজন্ম লাঠি, হকি, হাতুড়িঁ নিয়ে খেলা করে? সেখানে তাদের শিক্ষাগুরুরা কত অনুপ্রেরনা দেয়! তুমি কি দেখনি, কিছুদিন আগে সুইংগাম লাগানোয় বকা দেয়াতে তোমার সহকর্মীর চাকুরী চলে গেছে? অতিরিক্ত নৈতিকতা দেখাতে গিয়ে যৌন কেলেংকারীতে ফাঁসানো হয়েছে তোমার হাজারো সহকর্মীকে? তুমি কি দেখনি, দুদিন আগে গলায় জুতার মালা পরিয়ে ঘুরানো হয়েছে তোমার প্রধানকে? তোমার কি মনে নেই মাথায় মল ঢালার সে স্মৃতিগুলো? কিংবা কান ধরে উঠবস করার সোনালী স্মৃতিগুলো? তুমি কি জানো, ওদের ক’জনেরই দেহে বাবার রক্ত আছে? প্রতিবেশির রক্তে গড়া সোনার ছেলেদের কেন তুমি মানুষ করতে গেলে? জানি তুমি কোন উত্তর দিবেনা? ঘরে বৃদ্ধ বাবা-মা আছে, রাত হলে ছেলেটি বাবার বুকে মাথা রাখতে চাইবে, সদ্য বিধবা হওয়া বালিকার দুঃখ তুমি কি বুঝবে? ক্ষমা করো মাস্টার মশায়, বঙ্গদেশে পুনঃজন্মে কখনোই মাস্টার হইয়োনা” শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের এই সমস্যারগুলোর সমাধান না করতে পারলে আমরা ভয়ংকর ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছি৷ যার মাশুল আগামীতে আমাদের সবাইকে দিতে হবে। সমস্যা সমাধানে আমার কিছু প্রস্তাবনাঃ ক) রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত হওয়া খ) কঠোর আইন প্রনয়ণ ও প্রয়োগ করা। গ) অভিভাবক সহ সমাজের সবারই সচেতনতা বৃদ্ধি করা। ঘ) প্রতিষ্ঠান প্রধান নিয়োগে স্বচ্ছতা। ঙ) কমিটি/ গভর্নিং বডির নুন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ। চ) প্রশাসন ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যেমন ইউএনও , ডিসি ও শিক্ষা কর্মকর্তা এঁদের সমন্বয়ে মাসিক / ত্রৈমাসিক / সাম্মাষিক সেমিনারের আয়োজন করা এবং নৈতিক শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করা। ছ) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয় থেকে শিক্ষকদের কে নির্দিষ্ট হারে বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ও ঊৎসব ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করা।
মন্তব্য করুন