ঘুরে এলাম সাগর কণ্যা কুয়াকাটা I

Spread the love

মোঃ মিজানুর রহমান জীবন।
 সাগরকণ্যা কুয়াকাটা বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর সকল পর্যটকের কাছে অন্যন্য নাম। ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সৈকত বিশিষ্ট কুয়াকাটা বাংলাদেশের অন্যতম নৈসর্গিক সমুদ্র সৈকত। এটি বাংলাদেশের একমাত্র সৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতটি কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলি ইউনিয়নের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত। সমুদ্রের বুকে চর জেগে এ সৈকত হয়েছে।
ধারনা করা হয় সুলতানি বা মুঘল আমলে এ অঞ্চলে মানব বসতি শুরু হয়। কুয়াকাটা নামের পিছনেই এই ইতিহাসের ধারনা মেলে কুয়াকাটা নামের পেছনে রয়েছে আরকানদের এদেশে আগমনের সাথে জড়িত ইতিহাস। ‘কুয়া’ শব্দটি এসেছে ‘কুপ’ থেকে। ১৮ শতকে মুঘল শাসকদের দ্বারা বার্মা থেকে বিতাড়িত হয়ে আরকানরা এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে। তখন এখানে সুপেয় জলের অভাব পূরণ করতে তারা প্রচুর কুয়ো বা কুপ খনন করেছিলেনে, সেই থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয়ে যায় কুয়াকাটা।
ইতিহাস ঐতিহ্যে বাকেরগঞ্জ একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান। ত্রয়োদশ শতকে চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের প্রতিষ্ঠার তথ্য মেলে বাউফলের কচুয়ায়। ১৫৮২ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের সময় বাকেরগঞ্জ ও পটুয়াখালীকে বাকলা সরকার বলা হয়। তবে ইতিহাসের পাতায় জানা কুয়াকাটা রাখাইনের প্রতিষ্টিত। স্থানীয় তথ্য সূত্র মতে ১৯০৩ সালে কুয়াকাটাতে প্রথম বাঙ্গালী ভাগ্যানুসন্ধানে আসে।
কুয়াকাটা এখন পর্যটন নগরী হিসাবে সমস্ত বিশ্বে পরিচিত। পাশাপাশি হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের কাছে একটি তীর্থস্থান। নভেম্বরের রাস মেলায় হিন্দুসম্প্রদায়ের কৃষ্ণভক্তরা হাজির হয়। তেমনি মাঘী পূর্ণিমায় আয়োজন করা পবিত্র স্নান। এসময় দেশি বিদেশি লক্ষ লক্ষ পূণ্যার্থীর আগমন ঘটে এখানে।
জানা যায় রাখাইনদের আদি নিবাস ছিল মায়ানমারের আরাকান প্রদেশে। ১৭৮২ সাল থেকেই রাখাইনদের উপর বিভিন্ন অত্যাচার করা হয়। ১৭৮৪ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত মায়ানমারের শরনার্থীর সংখ্যা দাড়ায় প্রায় এক লক্ষ।
রাখাইনরা মায়ানমার ত্যাগ করে বাংলাদেশে বসবাস করলেও তারা তাদের ঐতিহ্যেকে ধরে রাখে। বিশেষ করে রাখাইনদের খাদ্য, পোশাক ও ভাষায় তারা বাঙ্গালীদের থেকে স্বতন্ত্রতা বজায়ে রাখে। বিয়ে অনুষ্ঠানে রাখাইনরা সংস্কার মেনে চলে। যেমন বর্ষাকালে রাখাইনদের মধ্যে কোন ধরনের বিয়ে হয় না।
নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এক মোহময় লীলাভূমির নাম কুয়াকাটা। সরকার এই পর্যটন নগরীকে আধুনিক সুযোগ সুবিধা দেয়ার লক্ষ্যে কুয়াকাটাকে পৌরসভা হিসাবে ঘোষণা করে। কুয়াকাটার খ্যাতনামা কুয়া যা ছিল এক সময়ের মিষ্টি পানির একমাত্র আধার  তা এখন ঐতিহ্যের অংশ।
কুয়াকাটার দর্শনীয় স্থানসমূহ:
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতঃ  কুয়াকাটার মূল আকর্ষণ সমুদ্র সৈকত। সমুদ্র সৈকতে দাড়ালে দক্ষিণে যতদূর চোখ যায় ততদূর নীলাকাশ। বেলাভূমিতে প্রতিমুহুর্তে আছড়ে পড়ছে ঢেউ। সমুদ্র সৈকতে হাজার হাজার পর্যটকদের জন্য বেসরকারিভাবে বসার জায়গা, ঘোড়া, গাড়ি, খাবার সহ বিভিন্ন ব্যবস্থা রয়েছে। পাশাপাশি কুয়াকাটায় পর্যটন পুলিশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে।
ঝাউবনঃ সমুদ্রসৈকতের ভাঙ্গন ঠেকানোর জন্য বনবিভাগের মনোলোভা ঝাউবন রয়েছে কুয়াকাটায়। যেখানে বাতাসের শব্দ শো শো করতে থাকে। আমাবশ্যার অন্ধকারে রাতে ফসফরাসের মিশ্রনে সাগরের ঢেউগুলো আলোর বিচ্ছুরণ ছড়ায় বলে টুরিস্ট গাইডরা জানিয়েছেন।
কুয়াকাটার কুয়া: কুয়াকাটা নামটি কুয়া থেকে এসেছে। সমুদ্রের লবণ পানির এলাকায় মিষ্টি পানির একমাত্র আধার এই কুয়া। ভূগর্ভস্থ পানি বা বর্ষার পানি থেকে এই কুয়ায় পানি থাকে। কুয়াকাটার বৌদ্ধ বিহারে প্রবেশের মুখে কুয়াটি অবস্থিত।  সরকারের আর্থিক সহায়তায় কুয়াটিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে।  কুয়ার পাশেই রয়েছে বৌদ্ধমন্দির। যা শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধ বিহার নামে পরিচিত। এখানে নয়টি ধাতুর সমন্বয়ে তৈরি বৌদ্ধ মূতি রয়েছে।
নৌকা জাদুঘর : শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধবিহার ও রাখাইন মার্কেটের সংলগ্ন বেড়িবাধের ঢালে কুয়াকাটার নৌকা জাদুঘর অবস্থিত। এখানে একটি পাল তোলা জাহাজের ধ্বংসাবশেষ রাখা আছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর নৌকাটিকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। নৌকাটি ৭২ ফুট দৈর্ঘ্য, ২২ ফুট প্রস্থ, ১১ ফুট উচ্চতা এবং ৯০ টন ওজনের। প্রাচীনকালে সমুদ্রপথে বিভিন্ন দেশের সাথে ব্যবসা বানিজ্য করার জন্য এসব পাল তোলা জাহাজ ব্যবহার করা হতো।
কেরানি পাড়া : কুয়াকাটার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত রাখাইন পল্লীর নাম কেরানি পাড়া। বৃটিশ আমলে নলাউ নামক একজন রাখাইন ব্যাংকের কেরানি পদে চাকরি করতেন। তার পদবী থেকে এই পল্লীর নাম হয় কেরানি পাড়া।
কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান (ইকোপার্ক) : কুয়াকাটা জিরোপার্ক থেকে দেড় কিলোমিটার পূর্ব দিকে ৭০০ একর জায়গা জুড়ে কুয়াকাটা ইকোপার্ক অবস্থিত। এখানে পরিকল্পিত ভাবে বিভিন্ন ধরনের বনজ ও ফলজ গাছ লাগানো হয়েছে।
গঙ্গামতির চর : কুয়াকাটার মূল পর্যটন স্পট থেকে ৬ কিলোমিটার পূর্ব দিকে গঙ্গামতি অবস্থিত। গঙ্গামতি খালের চরে গড়ে উঠায় চর গঙ্গামতি বা গঙ্গামতির চর বলা হয়। মূল স্পট এর চেয়ে এখান থেকে সূর্যোদয় ভালো দেখা যায়।
আব্দুল আলী গাড়ুলির স্মৃতি বিজড়িত স্থান : বিখ্যাত সাপুড়ে আব্দুল আলি গাড়ুলি যার সাপ ধরা নিয়ে বিভিন্ন লোক কাহিনী প্রচলিত আছে। মিশ্রিপাড়া থেকে ৭ কি.মি. উত্তরে বৌলতলী পাড়া এ স্থান।
মিশ্রিপাড়া সীমা বৌদ্ধ বিহার : কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে সাত কিলোমিটার পূর্ব দিকে মিশ্রিপাড়ায় রাখাইন পল্লী অবস্থিত। জানা যায় প্রভাবশালী মিশ্রি তালুকদারের নামে এ পল্লীটির নামকরণ করা হয়। এখানকার বৌদ্ধমন্দির যা সীমা বৌদ্ধ বিহার নামে পরিচিত। এখানে দুশো বছরের পুরাতন বৌদ্ধমূর্তি ও ভারত উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধ মূর্তি রয়েছে।
গোড়া আমখোলাপাড়া রাখাইন পল্লী : কুয়াকাটার সবচেয়ে বড় রাখাইন সম্প্রদায়ের বসতি গোড়া আমখোলাপাড়া রাখাইন পল্লীতে। আলীপুর বন্দর থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে এ রাখাইন পল্লী। এখানে টিন ও কাঠ ব্যবহার করে মাচার উপর মন্দিরে ছোট ছোট অনেকগুলো বৌদ্ধ মূতি রয়েছে।
আলীপুর ও মহিপুর মৎস্য বন্দর : বাংলাদেশের অন্যতম মৎস্য বন্দর এটি। আলীপুর বন্দরের পাশে কালাচান পাড়া নামে রাখাইন পল্লী রয়েছে। এ রাখাইন পল্লীটি কুয়াকাটার দ্বিতীয় বৃহত্তম।
নয়পাড়া বৌদ্ধবিহার: আলীপুর থেকে কুয়াকাটা যাবার দেড় কিলোমিটার দক্ষিনে রাখাইনদের ছোট একটি পল্লী রয়েছে যা নয়াপাড়া নামে পরিচিত। চারটি পরিবারের বাস এ পল্লীতে কিন্তু এখানে সুন্দর একটি বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে। মন্দির দেয়ালে বৌদ্ধদেবের জীবচিত্র আকা আছে
ইলিশ পার্ক এন্ড রিসোর্ট: কুয়াকাটা পৌরসভায় ইলিশ পার্ক অবস্থিত। জিরো পয়েন্ট থেকে পাঁচ  মিনটের পথ। ৪০ শতাংশ জমির উপর এ পার্কটি অবস্থিত। পার্কের ভিতরে বিভিন্ন প্রাণির ভাস্কর্য রয়েছে।
শুটকি পল্লী : কুয়াকাটায় শুটকির চাহিদা না থাকলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে শুটকির চাহিদা থাকায় কুয়াকাটায় শুটকি শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। সমুদ্র সৈকতের পশ্চিম পাশে লেম্বুর চরে অস্থায়ীভাবে বাশ দিয়ে শুটকির মাচা তৈরি করা হয়।
স্বপ্নরাজ্য পার্ক ও রিসোর্ট : কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে বেড়িবাধের সাথেই স্বপ্নরাজ্য পার্ক ও রিসোর্ট অবস্থিত। এখানে ছোট একটি পার্ক রয়েছে। পার্কে কয়েকটি জীবন্ত প্রাণি রয়েছে।
লেম্বুর বন: পর্যটকরা লেবু বন বা বাগান মনে করতে পারেন আসলে লেম্বু ছিল রাখাইন সম্প্রদায়ের একটি মেয়ে। তার বাড়ি ও বাগান এখানে ছিল। সমুদ্রে সে বাড়ি হারিয়ে গেছে। এখান থেকে পশ্চিমে ফাতরার বন দেখা যায়। লেম্বু বাগান থেকে সূর্যাস্ত সবথেকে ভাল দেখা যায়। এখানে সামুদ্রিক শামুক-ঝিনুকের প্রচুর খোলস পাওয়া যায়। এখানে বেশ কিছু দোকান গড়ে উঠেছে। কাকড়া বা মাছ ফ্রাই করে খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
ফাতরার বন: আন্ধারমানিক নদীর মোহনা পার হয়ে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেষে এ ম্যানগ্রোভ বন গড়ে উঠেছে। এ বনের মধ্যে হরিণ, বানর, শুকর, বন মোরগ, শিয়াল, বাঘডাস, মেছোবাঘ, ভোদর, খরগোশ, অজগর দেখতে পাওয়া যায় বলে টুরিস্ট গাইডরা আমাদেরকে জানিয়েছেন।  বনের দক্ষিন পশ্চিম পাশে সরকারের অর্থায়নে ইকোপার্ক তৈরি হয়েছে।
লাল কাঁকড়ার চর : কুয়াকাটার বেশ কিছু স্থানেই লাল কাকড়া দেখতে পাওয়া যায়।
পানি জাদুঘর : মানুষকে পানি সম্পদ ব্যবহারে সচেতন করার জন্য এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এশিয়ার প্রথম পানি জাদুঘর। কলাপাড়া উপজেলা থেকে ৬ কিলোমিটার দক্ষিনে পাখিমারা বাজারে পাশে অবস্থিত। একটি বেসরকারি সংস্থার উদ্যেগে এটি প্রতিষ্ঠিত। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল নয়টা  থেকে পাঁচটা  পর্যন্ত খোলা থাকে।
সোনার চর : পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলায় সোনার চর অবস্থিত। বঙ্গোপসাগরের বুকের এ চরটি দক্ষিণ সীমার শেষ ভূখন্ড। এখানেও বিভিন্ন ধরনের পশু পাখি রয়েছে।
কত সময় নিয়ে যাবেন কুয়াকাটাঃকুয়াকাটা ভ্রমণ করতে গেলে পর্যটকদের হাতে সর্বনিম্ন দুই দিন রাখতে হবে। কুয়াকাটায় বিভিন্ন ধরনের প্যাকেজ ট্যুরের ব্যবস্থা রয়েছে। জল ও স্থল পথে এ ভ্রমণ গুলোর ব্যবস্থা রয়েছে। কুয়াকাটা জিরো পয়েন্টের বেড়িবাধ, কেরানি পাড়া সহ বিভিন্ন জায়গায় খাবার হোটেল রয়েছে। কম দামী ও বেশি দামী বিভিন্ন মানের খাবার পাওয়া যায়। কুয়াকাটার রাখাইনদের লোকসঙ্গীত, অভিনয়, নৃত্য ইত্যাদি আয়োজনের ব্যবস্থা রয়েছে। পর্যটকদের চাহিদা অনুসারে তারা আয়োজন করে থাকে। কুয়াকাটায় অনেকগুলি মার্কেট রয়েছে তার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পোশাক , শামুক, ঝিনুকের কাজ সহ বিভিন্ন দ্রব্যাদি পাওয়া যায়। পর্যটক সহ স্থানীয়দের স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার জন্য তুলাতলীতে ২০ শয্যা বিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। কুয়াকাটায় পর্যটকদের আবাসনের ব্যবস্থা করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ধরনের হোটেল ও মোটেল রয়েছে। এসব হোটেলে বিভিন্ন ধরনের বেড এসি, নন এসি থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। কুয়াকাটায় অন্তত: ৬০ টি হোটেল মোটেলে ১০০০০ লোকের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটায় বিভিন্ন ভাবে যাতায়াত ব্যবস্থা রয়েছে। ঢাকা কুয়াকাটা এসি, নন এসি বাস রয়েছে। এছাড়াও রংপুর বিভাগের পর্যটকরা বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে সরাসরি বাসে কিংবা ব্যক্তিগত গাড়িতে চেপে যেতে পারেন সাগর কণ্যা কুয়াকাটায়।এছাড়া ঢাকা পটুয়াখালী লঞ্চ সার্ভিস রয়েছে। আকাশপথে বরিশাল গিয়ে কুয়াকাটায় যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।

Spread the love

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।