ওমর আলী বাবু,জয়পুরহাট প্রতিনিধিঃ
উত্তরের জেলা জয়পুরহাটে হিমেল হাওয়া ও ঘন কুয়াশায় শীতের তীব্রতাকে বাড়িয়ে তুলছে।জয়পুরহাটে সরিষার ফলন দিন দিন বাড়ছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মধু সংগ্রহ করছেন মৌ-চাষীরা। মৌ-চাষীরা সরিষা থেকে মধু সংগ্রহ করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সরিষা চাষে পুরোমাঠ যেন ঢেকে আছে সুন্দর এক হলুদের চাদরে। এমন চাদরে ঘেরা প্রকৃতিতে ফুলের গন্ধ আর মৌমাছির গুঞ্জন জয়পুরহাটের মাঠেমাঠে। রাস্তার দুধারে বিস্তীর্ণ হলুদ চাদরের মাঠের মধ্যে মনচাইবে নিজের ছবিটুকু স্মৃতিসংরক্ষণ করতে।
জেলা কৃষিসম্প্রসারন অধিদপ্তরের তথ্য মতে চলতি মৌসুমে জেলায় সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে। তবে কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় বিনা মূল্যে কৃষকদের বীজ ও রাসায়নিক সার বিতরণ, রাজস্ব প্রদর্শনীও ফলোআপ কার্যক্রমসহ অন্যান্য প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের সহায়তা ও উদ্বুদ্ধ করণের ফলে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ১৪ হাজার ৬৬০ হেক্টর সরিষা আবাদ হয়েছে।
জয়পুরহটে বিভিন্ন উপজেলায় মধু চাষীরাও ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সরিষার ক্ষেত থেকে মধু সংগ্রহ করতে। ফসলির জমির পাশে পোষা মৌমাছির শতশত বাক্স নিয়ে হাজির হয়েছেন মৌয়ালরা। তারা প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মধু সংগ্রহের জন্য জয়পুরহাটে আসেন। ওই সব বাক্স থেকে হাজার হাজার মৌমাছি উড়ে গিয়ে মধু সংগ্রহে ঘুরে বেড়াচ্ছে সরিষাফুলের মাঠে। এ জেলার সদর উপজেলার পুরানা পৈল এলাকার হাতিগাড়া, হালট্রি এলাকাসহ জেলার বিভিন্ন এলাকার ফসলের মাঠঘুরে এমনচিত্র দেখা গেছে।
প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত মৌ-চাষিরাএসব মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহকরেন। মৌচাষের মাধ্যমে চাষীরা একদিকে যেমন আর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছেন, অন্যদিকে দূরহচ্ছে বেকারত্ব। পরবর্তীতে বাক্স গুলো সরিষা ক্ষেতের পাশে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়। পাশাপাশি বাক্স গুলোর ভেতরে দেওয়া হয় রাণী মৌমাছি। যাকে ঘিরে আনাগোনা করে হাজারো পুরুষ মৌমাছি। রানির আকর্ষণে সরিষাফুল থেকে মধু সংগ্রহকরে মৌমাছিরা। একটি রাণী মৌমাছির বিপরীতে প্রায় তিন থেকে চার হাজারের মতো পুরুষ মৌমাছি থাকে একেকটি বাক্সে।
জয়পুর হাট সদর উপজেলার হালট্রি গ্রামেগিয়ে দেখা যায়, গাইবান্ধা জেলা থেকে আগত মুসফিক ইসলাম নামে এক মৌয়ালী তার পছন্দের সরিষা ক্ষেতের পাশে খোলা জায়গায় চাক ভরাবাক্স ফেলে রাখেন। একেকটি বাক্সে মোমদিয়ে তৈরিছয় থেকে সাতটি মৌচাকের ফ্রেমরাখা হয়। আর তার ভেতর রাখা হয় একটি রাণী মৌমাছি। রাণী মৌমাছির কারণে ওই বাক্সে মৌমাছিরা আসতে থাকে। মৌমাছিরা ফুল থেকে মধু এনেবাক্সের ভেতরের চাকে জমা করে। আর এই চাক থেকেই মধু সংগ্রহ করেন মৌমাছি চাষীরা।আমরা সরিষা ক্ষেত থেকে বছরে চারমাস মধু সংগ্রহ করে থাকি। অন্য আটমাস কৃত্রিম পদ্ধতিতে চিনি খাইয়ে মৌমাছিদের পুষে রাখি। ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সরিষা থেকে মধু সংগ্রহের উপযুক্ত সময় যা এক দিকে সরিষা বিক্রি করি আর অন্য দিকে মধু সংগ্রহকরে অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হচ্ছি।
মধু সংগ্রহক রতে আসা রবিন ইসলাম বলেন, আমরা মধু সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছি। মধু সংগ্রহের জন্য স্টিল ও কাঠদিয়ে তৈরি প্রায় ১২০ টি বাক্স নিয়ে এসেছি। বাক্সের ভেতরে কাঠের তৈরি সাতটি ফ্রেমের সঙ্গে মোমদিয়ে বানানো বিশেষ কায়দায় লাগানো থাকে এক ধরনের সিট।প্রতিটি বাক্স থেকে ৬-৭ কেজি মধু পাই। সব গুলো বাক্স মিলে ৭ থেকে ৮ মন মধু সংগ্রহ করেছি। এই মধু গুলো আশেপাশের লোকজনের চাহিদা পূরন করে আমরা বিভিন্ন কোম্পানীতে সরবরাহ করি।প্রতি কেজি মধু ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দামে বিক্রি করি।এসব সরিষা ফুলের মধু খাঁটি ও সুস্বাদু হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে কুড়িয়ারের মাধ্যমে সরবরাহ করি । দারাজসহ বেশ কয়েকটি বড়বড় কোম্পানী এই মধু সংগ্রহকরে। দেশের পাশাপাশি দেশের বাহিরে ও এই মধু রপ্তানি করা হয়।
মধু কিনতে আসা মজিবর রহমান বলেন, মধু স্বাস্থ্যের জন্য উপকার তাই জয়পুরহাট শহর থেকে মধু কিনতে এসেছি। প্রতি কেজি মধু ৩০০ টাকাকিনেছি। এখানেখাঁটি মধু পাই তাই প্রতিবছর এখান থেকে মধু কিনে নিয়ে যাই।
স্থানীয় কৃষক আব্দুস সাত্তার বলেন আমাদের এলাকায় প্রতিবছর মধু সংগ্রহের জন্য আসে মৌমাছি চাষীরা ।এতে করে আমাদের সরিষার ফলন আরও ভালো হয়।এখানে সরাসরি দেখতেছি মধু সংগ্রহ করার পদ্ধতি।এই মধুতে কোন ভেজাল নেই।এই জন্য আমি মধু কিনতে এসেছি।
বিসিক জেলা কার্যালয় জয়পুরহাট এর উপ-ব্যবস্থাপক লিটন চন্দ্র ঘোষ জানান, চলতি মৌসুমে এ জেলায় ৩০ মেট্রিকটন মধু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে ১০০ জন কৃষকেপরামর্শ ও উৎসাহিত করছি। যাতে সরিষা ক্ষেতে মৌবাক্স স্থাপনের মাধ্যমে মৌচাষ করে তারা আর্থিক ভাবে লাভবান হতে পারেন। কৃষকরা আগ্রহ প্রকাশ করলে তাদের জন্য প্রয়োজনে আবারও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।সরিষাফুল থেকে সংগ্রহ করা মধু গুণে ও মানে অত্যন্ত ভালো। সরিষা ফুলের মধুতে কোনো প্রকার ভেজাল থাকেনা। একেবারে খাঁটি। আর এভাবে অনেকটা সহজ প্রক্রিয়ায় মধু আহরণের মাধ্যমে বাড়তি আয়করতে পারেন সংশ্লিষ্টরা। সরিষা ক্ষেতে মৌমাছির বিচরণ থাকায় ফুলের পরাগায়নে সহায়তা হয়, ফলে সরিষার ফলনও হয় বেশি।
মন্তব্য করুন