লেখক মোঃ মিজানুর রহমান জীবন।
আজ মংগলবার।২১ শে ফেব্রুয়ারী। ২০২৩ ইং। শহীদ দিবস। বাংলাদেশ সহ জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলিতে যথাযথ মর্যাদায় দিবসটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে। চলুন শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সম্বন্ধে এর ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট একটু জেনে নেই। বিশেষ করে আমার আজকের লেখা মুলত শিক্ষার্থীদের জন্য।
ভাষা আন্দোলন ২১ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশ সহ পশ্চিমবঙ্গের সকল বাংলাভাষী মানুষের জন্য একটি গর্বের দিন। এটি শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নামেও পরিচিত। এটি বাঙালির ভাষা আন্দোলনের দুঃখজনক ও গৌরবময় স্মৃতিতে পূর্ণ একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৫২ সালের এই দিনে (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮, বৃহস্পতিবার) বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের গুলিতে বহু যুবক শহীদ হন। তাদের মধ্যে রয়েছেন রফিক, জব্বার, শফিউর, সালাম, বরকতসহ আরও অনেকে। তাই এই দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে, প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়।
ভাষাবিরোধিতা শুরু হয় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে, বিভাগ-পরবর্তী রাজধানী ঢাকায়, পূর্ববঙ্গ। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে একটি সীমিত আন্দোলন হয়েছিল এবং ২১ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২-এ এটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল।
ওই দিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করে রাস্তায় নামলে পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়। এতে আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালামসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র, যুবক নিহত হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে জড়ো হন। নির্যাতনের পরও পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি আবারও আন্দোলনে নামে ছাত্র-ছাত্রীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ। তারা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের জন্য অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজায় অংশ নেন। ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারি মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে রাতারাতি একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়েছিল, যা ২৬ ফেব্রুয়ারি সরকার ভেঙে দেয়। ২১শে ফেব্রুয়ারির এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন গতি পায়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে জয়লাভ করলে, ৭ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি সংবিধান সংশোধন করা হয়।
১৯৮৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ ‘বাংলা ভাষা প্রচলন বিল’ পাস করে। যা ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ থেকে কার্যকর হয়।
কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে বসবাসকারী দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার জন্য আবেদন করেছিলেন। এ সময় মহাসচিব ২০ জানুয়ারী ১৯৯৮ তারিখে রফিককে জাতিসংঘের অন্য কোন সদস্য রাষ্ট্র থেকে অনুরূপ প্রস্তাবের ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করেন। পরবর্তীতে রফিক, আবদুস সালামের সাথে “মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অফ দ্য ওয়ার্ল্ড” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এতে একজন ইংরেজিভাষী, একজন জার্মান-ভাষী, একজন ক্যান্টোনিজ-ভাষী, একজন কাচি-ভাষী সদস্য ছিলেন। “এ গ্রুপ অফ মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড”-এর পক্ষ থেকে তারা আবার কফি আনানকে একটি চিঠি লেখেন এবং চিঠির একটি অনুলিপি ইউএনও-র কানাডার রাষ্ট্রদূত ডেভিড ফাউলারের কাছেও পাঠানো হয়।
১৯৯৯ সালে তারা জোসেফ এবং পরে ইউনেস্কোর আনা মারিয়ার সাথে দেখা করেন, আনা মারিয়া পরামর্শ দেন যে, তাদের প্রস্তাবটি ৫ সদস্য দেশ – কানাডা, ভারত, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড এবং বাংলাদেশ দ্বারা এগিয়ে আনা উচিত। এরপর ২৯টি দেশ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রস্তাবে সমর্থনের অনুরোধ করতে কাজ করে।
প্রস্তাবটি ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে উত্থাপিত হয়েছিল এবং যখন ১৮৮টি দেশ এটিকে সমর্থন করেছিল, তখন ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। এবং ২২শে ফেব্রুয়ারি, ২০০০ সাল থেকে দিবসটি পালিত হচ্ছে যথাযথ মর্যাদার সাথে।
বৃহস্পতিবার, ২১ অক্টোবর, ২০১০তারিখে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৫ তম অধিবেশনে, জাতিসংঘ এখন থেকে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের বিষয়ে একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। প্রস্তাবটি মে মাসে তথ্য সংক্রান্ত ১১৩ সদস্যের জাতিসংঘের কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে পাস করে।
১৯৫২ সাল থেকে প্রতি বছর এই দিনটি জাতীয় শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথমে রাষ্ট্রপতি ও পরে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য, উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পদে ঢাকাস্থ দূতাবাস, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন এবং সর্বস্তরের মানুষ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
মন্তব্য করুন