মিজানুর রহমান, নিজস্ব প্রতিবেদক: মাধ্যমিক শিক্ষার মাঠ প্রশাসন যেসব কর্মকর্তা ছাড়া প্রায় অচল, সেই কর্মকর্তাদের রাজস্ব খাতে স্থানান্তরে সম্মতি দিচ্ছে না অর্থ বিভাগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুশাসন থাকলেও গত চার বছর ধরে এই কর্মকর্তাদের ‘হয়রানি করা হচ্ছে’ বলে অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, এক দফায় রাজস্ব খাতে স্থানান্তরে ৮০১টি পদ সৃষ্টির সম্মতি দিলেও পরে বাকি পদের সম্মতি চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে অর্থ বিভাগ জানিয়েছে, প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের সুযোগ নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৮০১টি পদ রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের পর নতুন করে বাকি পদ সৃষ্টির সুযোগ নেই, এটি বলা অবান্তর। এটি অর্থ বিভাগের ‘দ্বিমুখী নীতি’।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রামে (সেসিপ) প্রেষণসহ ১ হাজার ৪৮৭ জন কর্মকর্তা দেশের মাধ্যমিক শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুগোপযোগী সংস্কার ও শিক্ষা মাঠ প্রশাসন পরিচালনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। যাদের বেশিরভাগকেই পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতার প্রমাণ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়োগ করেছিল।
এসব কর্মকর্তাকে উন্নত প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্যও প্রস্তুত করা হয়েছে ইতোমধ্যে। কারিকুলাম ছাড়াও সরকারের অর্থ ব্যয় করে তাদের বিভিন্ন উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালের পর সেসিপের মেয়াদ শেষ হলে, আর রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করা না গেলে তাদের চাকরির অবসান ঘটবে। এতে অচল হয়ে পড়বে মাধ্যমিক শিক্ষা মাঠ প্রশাসন। এতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন হবে দুরূহ।
প্রশিক্ষিত ও দক্ষ আরও ১ হাজার ৪৩৯ জন (প্রেষণের নিয়োগ ছাড়া) চার থেকে ১৬ বছর ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন, যারা এই দীর্ঘ সময় একই বেতনে চাকরিরত। সর্বশেষ সরকারি-বেসরকারি সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ৫ শতাংশ বিশেষ সুবিধা পেলেও সেই সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছেন বলে জানায় মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে গুণগত মানসম্পন্ন মাধ্যমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য সরকার ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে ১৯৯৯-২০০৭ মেয়াদে সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (এসইডিপি) এবং ২০০৭-২০১৪ মেয়াদে সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেসিপ) সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়।
শেষ হওয়া প্রকল্প দুটির ধারাবাহিকতায় প্রোগ্রাম অ্যাপ্রোচে ২০১৪-২০২৩ মেয়াদে (প্রথম ট্রাঞ্চ ২০১৪-২০১৭ ও দ্বিতীয় ট্রাঞ্চ ২০১৫ থেকে ২০১৭) সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেসিপ) বাস্তবায়িত হয়। ট্রাঞ্চ-১ ও ট্রাঞ্চ-২-এর মেয়াদকাল দুই বছর বাড়িয়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত যুগপৎভাবে চলমান থাকে। এরপর ট্রাঞ্চ-৩ প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদিত এবং বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এসইডিপি) ২০১৮ থেকে ২০২৩ মেয়াদে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
সেসিপের আওতায় সারা দেশে প্রেষণসহ সর্বমোট ১ হাজার ৪৮৭ জন জনবলের সংস্থান ছিল। শেষ হওয়া সেসিপ ও এসইডিপি প্রকল্পে নিয়োজিত জনবলের অধিকাংশই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে বর্তমানে চলমান সেসিপ প্রোগ্রামে নিয়োগ পায়।
বিভিন্ন প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ হিসেবে গড়ে তুলে মাঠ ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ের মাধ্যমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরের সক্ষমতা বাড়িয়েছেন এই কর্মকর্তারা। সেসিপের আওতায় সারা দেশে মোট ১ হাজার ৪৮৭ জনবল থাকলেও চাকরির ভবিষ্যৎ না থাকায় অনেকে প্রকল্প ছেড়ে চলে যান। বর্তমানে ১ হাজার ৪৩৯ জন কর্মরত আছেন।
এসব কর্মকর্তার পদ রাজস্ব খাতে স্থানান্তরে ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নীতিগত অনুমোদন চায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পদ বিভাজন করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো সারাংশে উল্লেখ করা হয়—প্রেষণে নিয়োজিত ১২৬টি পদ সৃষ্টি এবং সরাসরি নিয়োগ করা এক হাজার ৩৩৯টি পদ জনবলসহ সর্বমোট এক হাজার ৪৩৯টি পদ রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের নীতিগত অনুমোদন প্রয়োজন।
জানা যায় যে, ২০১৯ সালের মে মাসে ওই সময়ের সিনিয়র সচিব মো. সোহরাব হোসাইন (বর্তমানে পিএসসির চেয়ারম্যান) সারাংশ প্রস্তুত করে পাঠান। ওই সারাংশে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী সই করে পাঠান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারাংশ অনুমোদন দিয়ে সই করেন ২০১৯ সালের ২৪ জুন।
প্রধানমন্ত্রীর এই অনুশাসনের পর অর্থ বিভাগের ব্যয় ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ ২০২১ সালে ১২ দফা শর্ত দিয়ে ২০২২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ৮০১টি পদ রাজস্ব খাতে স্থানান্তরে অনুমোদন দেয়। এই পরিস্থিতিতে ২০২২ সালের ২২ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর আবার চিঠি পাঠানো হয়।
ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘সেসিপ প্রকল্পের এক হাজার ৪৮৭টি পদ সৃষ্টিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্মতি দিয়েছে। গত ৪ আগস্ট অর্থ বিভাগে স্থানান্তরের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছ। কিন্তু অর্থ বিভাগ থেকে জনবলসহ রাজস্ব খাতে স্থানান্তর ছাড়া শুধু মাত্র ৮০১টি পদ সৃষ্টির অনুমোদন দেওয়া হয়। ফলে সেসিপ কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর মাঠ পর্যায়ে শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি হবে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সম্মতির ভিত্তিতে পুনরায় সম্মতি জ্ঞাপনের জন্য অনুরোধ করা হলো।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই চিঠির পর অর্থ বিভাগ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ২০২২ সালের ২৮ জুন চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়, ‘উন্নয়ন প্রকল্পের জনবল রাজস্ব খাতে স্থানান্তর/নিয়মিতকরণের কোনও সুযোগ নেই।’ অথচ একই প্রকল্পের একই রকম ক্ষেত্রে ২০২২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি অর্থ বিভাগ ৮০১টি পদ রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের সম্মতি দিয়েছে, যা অর্থ বিভাগের ‘দ্বিমুখী নীতি’ বলে উল্লেখ করছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগীরা।
প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদিত সারাংশ থেকে জানা গেছে, সারা দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের বিদ্যালয়, মাদ্রাসা এবং স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিদর্শন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের জন্য উপজেলা পর্যায়ে মাত্র একজন মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও একজন সহকারী মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রয়েছেন। আর বাকি পদগুলোর দায়িত্ব পালন করছেন সেসিপের কর্মকর্তা।
জেলা পর্যায়ে রয়েছেন একজন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও একজন সহকারী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। বাকি সব পদের দায়িত্ব পালন করছেন সেসিপ কর্মকর্তারা।
একইভাবে আঞ্চলিক পর্যায়ে একজন উপপরিচালক, দুই জন বিদ্যালয় পরিদর্শক (একজন পুরুষ ও একজন নারী), দুই জন সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক (একজন পুরুষ, একজন নারী) এবং একজন প্রোগ্রামারের পদ রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বাকি পদগুলোর সব কাজ করছেন সেসিপ কর্মকর্তারা। যেসব জেলায় জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নেই, সেসব জায়গায় সেসিপের কর্মকর্তা জেলা শিক্ষা অফিসারের দায়িত্ব পালন করছেন নির্ধারিত সামান্য বেতনে।
এছাড়া মাধ্যমিক শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুগোপযোগী সংস্কার এবং প্রকল্পের জনবলের মাধ্যমে কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, দুর্নীতি ও নকলমুক্ত পাবলিক পরীক্ষা আয়োজনে ট্যাগ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন, জাতীয় নির্বাচনসহ সব পর্যায়ের নির্বাচনে প্রিসাইডিং অফিসার ও অন্যান্য নির্বাচন সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব পালন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসগুলো যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন, বিজ্ঞান মেলা ও উন্নয়ন মেলা আয়োজন, সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতা, জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহের বিভিন্ন ইভেন্ট পরিচালনা, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ আয়োজন এবং অন্যান্য কার্যক্রম সুচারুরূপে সম্পাদনসহ সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে সেসিপ কর্মকর্তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন।
মন্তব্য করুন