জয়পুরহাট প্রতিনিধিঃ ওমর আলী বাবু।
ভোরের হিম এবং ঘন কুয়াশায় শীতের আমেজে জমে উঠেছে জয়পুরহাট কালাই উপজেলার ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা । স্থানীয়রা জানান, মেলাকে ঘিরে তাদের অনেক স্বপ্ন। কেননা তারা মেলা উপলক্ষে মেয়ে-জামাই, আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত করে একত্রিত হয়ে নবান্নকে ঘিরে আনন্দ উদযাপন করেন। এ জন্য প্রতিবছর তারা এই মেলার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। তবে এই মেলায় শুধুই মাছ কেনার বিষয় নয়, আছে একধরনের জামাই-মেয়েদের কেনার প্রতিযোগিতা। কোন জামাই কত বড় মাছ কিনলেন, সেটাই আসল বিষয়। প্রতিযোগিতায় নীরব অংশগ্রহণ করে শ্বশুরেরা।নবান্ন কে ঘিরে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বসেছে এ মেলা। আজ শনিবার ভোরথেকে শুরু হয়ে দিনব্যাপী চলবে মেলা। কালাই-মোকামতলা মহাসড়কের পাশে কালাই পৌরসভার পাঁচশিরা বাজারের এ মেলায় মাছ ব্যবসায়ীদের কন্ঠে ভেসে আসছিল, ‘ভাই…..মাছ…,বড়..বড় মাছ..,পুকুর, দিঘী ও নদীর মাছ। বাঁচা মাছ, খুব স্বাদের মাছ, দেখে যান, নিয়ে যান, এ মাছ ফুরাইলে আর পাবেনা ভাই…। ৩ থেকে ১৬ কেজির কাতলা, রুই, মৃগেল, ব্রিগেড, সিলভার মাছ। এভাবেই বলছিলেন তারা। মেলায় সারিবদ্ধ ও সুন্দর করে সাজানো কাতলা, রুই, মৃগেল, চিতল, ব্ল্যাককার্প, গ্রাসকার্প, কার্ফু, কালবাউশ, ব্রিগেড, সিলভার কার্পসহ হরেক রকমের মাছ ।
সেখানে ভোর থেকে বছেসে সারি সারি মাছের দোকান। চলছে হাঁকডাক ও দরদাম। মাছের আকার অনুযায়ী প্রতি কেজি মাছ ২শ ৫০ থেকে ৮শ’ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে মেলায়। ক্রেতারাও ব্যাপক উৎসাহের সঙ্গে কিনছেন ঐসব মাছ। আবার দেখতে এসেছেন অনেকেই।
এই মেলা কেন্দ্র করে ঘরে ঘরে এ উৎসবকে ঘিরে প্রতিটি বাড়িতেই মেয়ে-জামাইসহ স্বজনদের আগে থেকেই দাওয়াত দেওয়া হয়। এ অগ্রহায়ণ মাসে নবান্ন উৎসব উপলক্ষে প্রায় ঢের যুগের এই মাছের মেলায় অংশ নেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তর থেকে শত..শত মানুষ। উৎসব দেখতে আসেন। মাছের পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। দূর-দূরান্তর থেকে দলে দলে লোকজন মেলায় এসেছেন মাছ কিনতে। ক্রেতারা মাছের দাম হাকাচ্ছেন, কিনছেন, আবার কেউ কেউ সেলফি তুলছেন । ক্রেতারা সামর্থ্য অনুযায়ী মাছ কিনে খুশিমনে বাড়ি ফিরছেন।
মাছের মেলার সংবাদ পেয়ে শনিবার সকালের ট্রেনে মাছ কিনতে আসেন পঞ্চগড় সদর উপজেলার মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, অনেক মেলায় দেখছি কিন্তু এরকম মাছের মেলা দেখেনি। চিন্তা করছি আজকে মেলার সর্বোচ্চ বড় মাছকে আমি কিনব। মেলায় এসে আমার খুব ভালো লাগলো।
জয়পুরহাটের বানিয়াপাড়া থেকে মাছ কিনতে আসা গাজিউল হোসেন বলেন, আমি চেষ্টা করছি একটা কাতলা মাছ কিনবো। মাছের যে দাম তাতে আমার সাধ্য অনুযায়ী হচ্ছে না। তার পরও যাচাই-বাছাই করে একটি মাছ কিনেই বাড়ি ফিরবো।
আছমা খাতুন নামে একজন ক্রেতা জানান, মেলায় যত রকমের মাছ তাতে কোনটা ছেড়ে কোনটা কিনি ভেবে পাচ্ছিনা। অবশেষে ৮ কেজি ওজনের একটি রুই মাছ ৩৭শ’ টাকায় কিনেছি। মূলত মেলা ছিল অনেক আনন্দের।
উপজেলার বেগুন গ্রামে থেকে আসা ভ্যানচালক রায়হান বলেন, মেলায় যত বড় মাছ উঠেছে তা কেনার সামর্থ্য আমার নাই। তারপরও এলাকায় এত বড় একটা মাছের মেলা খালি হাতেত আর আর বাড়ি ফিরে যায়না। তাই পরিবারকে খুশি রাখার জন্য সাধ্যের মধ্যে ছোট্ট একটি মাঠ নিয়ে বাড়ি ফিরছি।
এই মেলায় মাছ বিক্রেতা তারেক রহমান বলেন, নবান্ন উপলক্ষে পাঁচশিরা বাজারে মাছের মেলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সামুদ্রিক ও পুকুকুরের ১০-১২ কেজি ওজনের মাছ বিক্রি করছি। ব্রিকেট সিলভার ৭০০-৮৫০ টাকা, ৪-৫ কেজি ওজনের বড় রুই ৭০০-৫৫০, কাতল পরিমাপ ভেদে ৬০০-৭০০ টাকা। এবছর বিক্রি পরিমান খুবই কম। এ নিয়ে আমরা ব্যবসায়ীরা খুব চিন্তায় আছি।
আঃ লতিফ বলেন, প্রতিবছর আমি এ মেলায় মাছ বিক্রি করে থাকি। গত বছরে এ সময়ের মতো ছয় মণ মাছ বিক্রি করতে পারলেও এখন পর্যন্ত বিক্রি করতে পেরেছি দুই মন। লোকজন কম বাজারে পরিস্থিতি তেমন ভালো না।
শ্রী রনি বলেন, মাছের মেলাতে বড় পুকুর, দিঘি ও নদী থেকে নানান জাতের বড় বড় মাছ সংগ্রহ করা হয়েছে। বিগত বছরের চেয়ে এ বছর বিক্রি কম তাই খুব চিন্তায় আছি। এতক্ষণে মাছ প্রায় বিক্রি শেষ হওয়ার কথা। কিন্ত, যা মাছ রয়েছে তা দিনে বিক্রি করতে পারব কিনা জানিনা। আর বেচাকেনা যাই হোক সবচেয়ে বড় কথা মেলাটি ঐতিহ্য ধরে রাখতে পেরেছে।
হাট ইজারাদারের পার্টনার ময়েন উদ্দিন বলেন, শুধু জয়পুরহাট নয় বিভিন্ন ডিস্ট্রিক্ট থেকে ব্যাপারীরা এ মেলায় মাছ এনে বিক্রি করেন। এবার মাছের বাজার স্বাভাবিক আছে এতে করে সবাই মাছ কিনতে পারবে।
কালাই পৌর মেয়র রাবেয়া সুলতানা বলেন, পাঁচশিরা বাজারে মাছের মেলায় উৎসবমুখর পরিবেশে মাছ কেনাবেচা হচ্ছে। এ মেলাকে ঘিরে আশেপাশের সকলে আনন্দিত। মেলা উপলক্ষে আশেপাশের গ্রামে চলে আনন্দ-উৎসব। লোকজন মেয়ে-জামাই ও অতিথি আপ্যায়নে বড়বড় মাছ কেনার জন্য মেলায় ভিড় করছেন। এর চাইতে সামনের বছরে যেন আরো ভালোভাবে মেলা উপহার দিতে পারি সে চেষ্টা করে যাবো।
কালাই উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িক্ত) আনোয়ার আলী জানান এই মেলাকে ঘিরে এলাকায় উৎসব মুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আর এই মেলাকে লক্ষ্যে করে ¯’স্থানীয় বড় মাছ ব্যবসায়ীরা ও মাছ চাষিরা বিভিন্ন এলাকা থেকে সপ্তাহ খানেক ধরে বড় বড় মাছ সংগ্রহ করে থাকেন।
মন্তব্য করুন