মোঃ রেজওয়ানুর রহমান শুভ
২৩ জুলাই শনিবার দুপুরে নবাবগঞ্জ উপজেলা মৎস দপ্তরের আয়োজনে জাতীয় মৎস সপ্তাহ পালন উপলক্ষ্যে স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করেছেন। নবাবগঞ্জ উপজেলা মৎস কর্মকর্তা মো. কাওসার হোসেন তার কার্যালয়ে গণমাধ্যম কর্মীদের মাঝে জাতীয় মৎস সপ্তাহ পালনের ব্যাপক ও বিস্তর ভাবে লিখিত বক্তব্য পেশ করেন। এসময় উপস্থিত ছিলেন মৎস বীজ ও খাদ্য উৎপাদন খামার ব্যবস্থাপক প্রফুল্ল চন্দ্র রায় সহ উপজেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি এম রুহুল আমিন প্রধান, প্রচার সম্মাদক ওয়ায়েস কুরুনী, কোষাধক্ষ্য মোঃ রেজওয়ানুর রহমান শুভ, সদস্য সাজেদুর রহমান সাগর, মাহাবুবুর রহমান, আব্দুর রাশেদ বিপ্লব, গোলাম রব্বানী, রনজিৎ কুমার রায় সহ স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীগণ। নিম্নে লিখিত বক্তব্যের প্রতিবেদন সন্নিবেশিত করা হলো: প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও ২৩-২৯ জুলাই ২০২২ খ্রি জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২২ উদযাপিত হতে যাচ্ছে। আজ থেকে শুরু করে সপ্তাহ ব্যাপী এ আয়োজনের এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, “নিরাপদ মাছে ভরবো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’’। এ উপলক্ষ্যে আমি আপনাদের মাধ্যমে উপজেলার সকল মৎস্য চাষি, মৎস্যজীবী, আড়ৎদার, মৎস্য ব্যবসায়ী সহ মৎস্য সেক্টরের সাথে জড়িত সকলকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার দুই বছর পরে কুমিল্লায় এক জন সভায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান “মাছ হবে দ্বিতীয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ” এ মর্মে ঘোষণা দেন। আজ বাংলাদেশে তৈরী পোশাক শিল্পের মতই মৎস্য ও মৎস্যজাত দ্রব্য রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে। শুধু তাই নয় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আমিষের ৬০ শতাংশ যোগান দেয় মাছ। আপনারা জেনে অত্যন্ত খুশি হবেন যে, বাংলাদেশ এখন মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ১৯৮৩-৮৪ অর্থ বছরে মাছের মোট উৎপাদনছিল ৭.৫৪ লাখ মেট্রিক টন। ৩৭ বছরের ব্যবধানে ২০২০-২১সালে এ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৪৬.২১লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ এ সময়ের ব্যবধানে মোট মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় গুণ এর কাছাকাছি। সরকারের বাস্তবমূখী কার্যক্রমের ফলে বাংলাদেশ এখন মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। মৎস্যজাত উৎস থেকে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ, দারিদ্র্য বিমোচন ও রপ্তানী আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে বর্তমান সরকার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। মৎস্য খাতের এ অনন্য সফলতা ধরে রাখার লক্ষে সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এগুলো হলো জাটকা সংরক্ষণ ও ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের আবাশ স্থল উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র সংরক্ষণ, পরিবেশ বান্ধন চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণ, সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের সহনশীল আহরণ, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা এবং স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ মাছ সরবরাহ এবং মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানী। ২০২২ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিসংস্থা এক প্রতিবেদন অনুযায়ী জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর দূষণের কারণে বিশে^র বেশিরভাগ দেশে স্বাদু পানির মাছের উৎপাদন কমছে। চাষের মাছের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা চলছে। এরমধ্যে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হিসেবে চারটি দেশ বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও উগান্ডা উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ৩য় এবং চাষের মাছ উৎপাদনও বাংলাদেশ একই অবস্থানে। প্রতিবেদনে আরোও বলা হয় স্বাদু পানির পাখনাযুক্ত মাছ উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশে^ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এসব মাছের মধ্যে ইলিশও রয়েছে। ইলিশ মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশে^ প্রথম অবস্থানে রয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে অন্যতম ভূমিকা ইলিশ মাছের। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরের ৪ লাখ ৯৬হাজার মে.টন ইলিশ উৎপাদিত হয়। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে এর উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫.৫৬ লাখ মে.টন। অধিদপ্তরের হিসাবে গত অর্থ বছরে দেশে উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশই ছিল ইলিশ। ইলিশের উৎপাদন বাড়ার প্রধান কারণ, কয়েক বছর ধরে ইলিশ রক্ষায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, কোস্টগার্ড, পুলিশ ও নৌবাহিনী সমন্বিতভাবে কাজ করছে। সবার সহায়তায় বিশেষ অভিযানও পরিচালনা করা হয়। তাতে জাটকা সংরক্ষণ ও মা ইলিশ রক্ষা পায়। এ কারণেই ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারোর তথ্যানুসারে, বাংলাদেশের মানুষের মাছ খাওয়ার পরিমাণও বেড়েছে। আগে জন প্রতি প্রতিদিন গড়ে ৬০ গ্রাম মাছ খেত, এখনতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬২ দশমিক ৫৮ গ্রাম। বিপন্ন প্রায় মাছের প্রজাতির সংরক্ষণ, অবাধ প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে সার্বিক মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি হয়েছে। গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন নদ-নদী ও অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের ৫৩৪টি মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপন করা হয়েছে। অভয়াশ্রম-সংশ্লিষ্ট জলাশয়ে মাছের উৎপাদন ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি হয়েছে। অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার ফলে বিলুপ্ত প্রায় এবং বিপন্ন ও দুর্লভ প্রজাতির মাছ, যথা একঠোঁট, টেরিপুঁটি, মেনি, রানী, গোড়া গুতুম, চিতল, ফলি, বামোস, কালিবাউশ, আইড়, টেংরা, সরপুঁটি, মধু পাবদা, রিঠা, কাজলি, চাকা, গজার, বাইম ইত্যাদির তাৎপর্যপূর্ণ পুনরাবির্ভাব ও প্রাপ্যতাবৃদ্ধি পেয়েছে। অভয়াশ্রমে দেশি কই, শিং, মাগুর, পাবদা, ইত্যাদি মাছের পোনা ছাড়ার ফলে এসব মাছের প্রাচুর্যও বৃদ্ধি পেয়েছে।গত কয়েক দশকে দেশে চাষ করা মাছে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে, শিং, মাগুর, পাবদার মতো আরও বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছ হারিয়ে যেতে বসেছিল। গবেষণার মাধ্যমে এই জাতের মাছ এখন চাষ হচ্ছে। দেশে বিপুল পরিমাণ পাঙাশ, তেলাপিয়া ও রুই জাতীয় মাছের উৎপাদন বেড়েছে। এখন শিক্ষিত তরুণেরা চাকরির দিকে না ঝুঁকে মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। এ ছাড়া ব্যাংক গুলো মৎস্য ও কৃষি কাজে সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে। এতে মাছের দিকে মানুষ ঝুঁকেছে। বাজারে মাছের ব্যাপক চাহিদা ও মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। মৎস্য ও মৎস্যজাত দ্রব্য বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য। ২০১৯-২০ সালে ৭০,৯৪৫.৩৯ মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে ৩ হাজার ৯৮৫.১৫ কোটি টাকার বৈদেশি কমুদ্রা অর্জিত হয়েছে। বর্তমানে এ সেক্টরে প্রায় ১৪ লক্ষাধিক নারী প্রত্যক্ষ/পরোক্ষ ভাবে জড়িত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৯অনুসারে ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৩.৫০% মৎস্য খাতের অবদান রয়েছে। দেশের মোট কৃষি আয়ের ২৫.৭২% আসে মৎস্য থেকে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে মৎস্য খাত ব্যাপক সফলতা অর্জন করছে। বাংলাদেশে থেকে গুনগত মানসম্পন্ন হিমায়িত চিংড়ি ও মৎস্যজাত পণ্য বিভিন্ন দেশে রপ্তানিকরা হচ্ছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২২ এর আনুষ্ঠানিক শুভ উদ্বোধন ও গণভবন লেকে মাছের পোনা অবমুক্ত করার সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন। এছাড়াও মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো ঃ আব্দুল হামিদ বঙ্গভবন লেকে মাছের পোনা অবমুক্ত করার জন্য সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন। এ বছর উপজেলা পর্যায়ে প্রচার প্রচারণা, সাংবাদিক সম্মেলন ও মাছের পোনা অবমুক্ত করণ অনুষ্ঠানের পাশাপাশি মৎস্য সেক্টরে বর্তমান সরকারের অগ্রগতি বিষয়ে আলোচনা সভা ও প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন, প্রান্তিক পর্যায়ে মৎস্য চাষী ও মৎস্য জীবিদের সাথে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ পূর্বক মতবিনিময়, উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় মৎস্য চাষিদের মাছ চাষ বিষয়ক বিশেষ সেবা প্রদান, পুকুরের মাটি ও পানি পরীক্ষা, সুফলভোগীদের প্রশিক্ষণ/ বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ এবং সর্বশেষ দিনে ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে সমাপনী অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন